বৈশাখী মেলায় ঐতিহ্যের খাবার

বৈশাখী মেলায় ঐতিহ্যের খাবার
১৪/০৪/২০১৭,শনিবার, ৮:১০

বর্তমান প্রজন্মের পছন্দের খাবার বার্গার, চিকেন ফ্রাই, ফ্রেন্সফ্রাই- এ সবই। দেশীয় ঐতিহ্যবাহী খাবারের সাথে তাদের বলতে গেলে পরিচয় হয়ই না। কিন্তু বৈশাখের মেলায় সে শহরেই হোক কিংবা গ্রামে পাওয়া যায় কদমা, বাতাসা, হাওয়াই মিঠাই, মুড়ি-মুড়কির মতো নানা ঐতিহ্যবাহী খাবার। যার সাথে পরিচিত হতে পারে বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা। এসব নিয়ে লিখেছেন
তাজুল ইসলাম, সিটি টিভি নিউজ।

বাঙালি সংস্কৃতি ও কৃষ্টির অপরিহার্য অংশ হলো মেলা। আমাদের জীবনের সাথে মেলার যোগ দীর্ঘকালের। উৎসব, বিনোদন, বিকিকিনি আর সামাজিক মেলবন্ধনের উত্তম ক্ষেত্র হচ্ছে মেলা। বিশেষ করে নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত বৈশাখী মেলা। মেলায় বিনোদনের পাশাপাশি রসনাতৃপ্তির জন্য থাকে বিভিন্ন রকম মিষ্টি, জিলাপি, সাজ-কদমা, খাজা-বাতাসা, হাওয়াই মিঠাইসহ হরেক রকম টক-ঝাল-মিষ্টি খাবারের দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। শিশু-কিশোরসহ সব বয়সীর প্রধান আকর্ষণ থাকে এসব মজাদার খাবারের প্রতি। আবহমান বাংলার দীর্ঘ দিনের লালিত ঐতিহ্যবাহী এসব খাবার নতুন প্রজন্ম কিংবা শহুরে মানুষের কাছে আরো পরিচিত করে দেয় মেলাসহ বিভিন্ন উপলক্ষ। গ্রামীণ সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগে নগর সংস্কৃতিতেও।
নববর্ষ উপলক্ষে শুধু গ্রামগঞ্জেই নয়, শহরেও আয়োজন করা হয় মেলার। দোকানিরা মুড়ি, মুড়কি, সাজ-কদমা, মিঠাইসহ নানা বর্ণের হরেক স্বাদের মুখরোচক খাদ্যদ্রব্য নিয়ে বসেন। আর নাগরিক জীবনেও এসব খাবারের কদর যেন আরো বেশি গাঢ়।
এসব খাবারের প্রধান তালিকায় থাকে নানা রকম বিন্নি খই, চিনি সাজ, বাতাসা, ছাতু, মিষ্টি ইত্যাদি। আর এসব খাবার নতুন প্রজন্মের কাছে করে তুলছে আরো আকর্ষণীয়।
গ্রামীণ মেলাকে কেন্দ্র করে বিন্নির সাথে বড় বাতাসা, ঘোড়া, হাতি, মটুক, পাখি ও নৌকার সাজ ছাড়া যেন চলেই না। আর এ সাজ তৈরি করেই সংসার চালাচ্ছে মানিকগঞ্জের প্রায় অর্ধশত পরিবার। বৈশাখী মেলা উপলক্ষে সাজ কারিগরদের সময় কাটে ভীষণ ব্যস্ততায়।
মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটীর ভাটারা গ্রামের কয়েক বণিক পরিবার প্রায় ১৫০ বছর ধরে বিন্নির সাজ তৈরি করে সংসার চালাচ্ছেন। ঘিওরের পয়লা, সিংগাইরের চান্দহর আর হরিরামপুরের ঝিটকা, কালোই, সরুপাই গ্রামের সাজ তৈরির কারিগরদের এখন দম ফেলার সময় নেই। গ্রাম কিংবা মেলার মধ্যে বিন্নির সাথে সাজ যেমনÑ বড় বাতাসা, ঘোড়া, হাতি, মটুক, পাখি ও নৌকা প্রয়োজন পড়ে। এ সাজ মানিকগঞ্জ ছাড়াও টাঙ্গাইল, ঢাকার জেলার বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে।
সরেজমিন দেখা যায়, সাটুরিয়া উপজেলার ভাটারা গ্রামের শ্যামল, দিলীপ বণিক এ সাজ তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সাজ সম্পর্কে তারা প্রথম ধারণা দেন, বিন্নি হচ্ছে কিছুটা মুড়ির মতো, বিন্নি ক্ষেতে হলে দুধ লাগে আর মিষ্টির জন্য এ সাজের প্রয়োজন পড়ে। সাজ শুধু চিনি দিয়ে বানানো হয়। আর বড় বাতাসা বানাতে গেলে চিনির সাথে আখের গুড় লাগে।
দিলীপ বণিক আরো জানান, প্রথমে বিশেষভাবে তৈরি করা পাতিলে চিনি জাল করা হয়, চিনি গলে গেলে, সে গরম চিনির পানি, ঘোড়া, হাতি, মটুক, পাখি ও নৌকার কাঠের ফর্মায় ঢালা হয়। মিনিট ১০ পরেই তা আবার ফ্রেম থেকে খুলে ফেলা হয়। আর তৈরি হয়ে যায় সাজ।
আর কদমা বানাতে গেলে চিনি জাল করে আবার তা ঠাণ্ডা করে, বিশেষভাবে বড় রশির মতো তৈরি করা হয়। পরে তা চিকন সুতা দিয়ে ছোট ছোট আকারে কাটা হয়, তখন তৈরি হয় কদমা । বৈশাখী মেলা উপলক্ষে প্রায় পাঁচ প্রকার সাজ তৈরি করা হচ্ছে।
এ সাজ করিগর ভগবত বণিক জানান, আমাদের বাপ-দাদারা এ ব্যবসা করতেন, তাতে কম করে হলেও প্রায় ১৫০ বছর ধরে এ ব্যবসা করে আসছি। তিনি আরো জানান, আমরা বর্তমানে পাঁচটি পরিবার এ সাজ তৈরি করে আসছি। মানিকগঞ্জের শুধু আমরাই এ ব্যবসা করে আসছি।
দিলীপ বণিক জানান, গত বছরের ১ বৈশাখে আমরা প্রায় ৩০০ মণ সাজ তৈরির অর্ডার পেয়েছিলাম। আমরা প্রতি কেজি সাজ পাইকারি বিক্রি করছি ৭০ টাকা, আর মেলার দিন তারা ১০০-১২০ টাকা কেজি বিক্রি করে থাকে। এক মণ সাজ তৈরি করতে খরচ হয় দুই হাজার ২০০ টাকা, আর পাইকারি বিক্রি করা যায় দুই হাজার ৮০০ টাকা । বড় বাতাসা এক দিনে দুই মণ তৈরি করা যায়, আর সাজ তৈরি করা যায় চার মণ পর্যন্ত। তিনি আরো জানান, গ্রাম্য মেলার চেয়ে শহরে এসব খাবারের চাহিদা আরো বেশি।
হরেক স্বাদের মিষ্টি ছাড়া বৈশাখী মেলা কল্পনাও করতে পারে না মানিকগঞ্জের লোকজন। এ ছাড়া সারা দেশেই রয়েছে মানিকগঞ্জের মিষ্টির কদর। রসগোল্লা, জিলাপি, দধি, মাষকলাই আমৃত্তি, রসমালাই, সন্দেশ, কালোজাম, চমচম তৈরি করতে দুধ, চিনি, গুড়, মাষকলাইসহ অন্যান্য উপকরণ ক্রয় এবং মিষ্টি তৈরি করার কাজে দম ফেলার ফুরসত নেই ঘোষপাড়ার নারী-পুরুষদের।
হাওয়াই মিঠাই! শিশুদের মন ভোলানো পছন্দের অন্যতম খাবার। মুখে দিলে নিমেষেই হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়। এক সময় গ্রামে গ্রামে হাঁক ডেকে বিক্রি করত হাওয়াই মিঠাই ফেরিওয়ালারা।
তবে বড়দের পছন্দের খাবারের তালিকায়ও জায়গা রয়েছে বাহারি রঙের, হরেক আকৃতির হাওয়াই মিঠাইয়

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.