সিটি টিভি নিউজ, ১১ জুন ২০১৭
মো. তাজুল ইসলাম
প্রতিদিন কারাগার থেকে বের করে প্রকাশ্যে দশটি করে চাবুক মারা হতো তাকে। চাবুকের আঘাতে তার শরীর থেকে রক্ত ঝরত, আর সে রক্তে কুফার মাটি রঞ্জিত হতো। যুগে যুগে বহু মহাপুরুষ ইসলামের খেদমত করে অমর হয়ে আছেন। ইমামে আজম হজরত আবু হানিফা (রহ.) তাদের অন্যতম। ইসলামের জ্ঞান ভাণ্ডারে তার অসামান্য অবদান চিরকাল মুসলিম উম্মাহর জন্য আলো হয়ে থাকবে।
জন্ম ও বংশপরিচয়
ইমাম আবু হানিফার পূর্বপুরুষরা কাবুলের অধিবাসী ছিলেন, তবে ব্যবসায়িক কারণে তারা কুফায় বসতি স্থাপন করেন। তার পিতা সাবিত একজন তাবেয়ি ছিলেন। প্রসিদ্ধ মতানুসারে, ইমাম আবু হানিফা ৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর, ৮০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম ছিল নোমান, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি "আবু হানিফা" উপনামে পরিচিতি লাভ করেন।
শিক্ষাজীবন
প্রথমদিকে পারিবারিক ব্যবসায় মনোযোগী হলেও ১৯-২০ বছর বয়সে ইমাম শাবী (রহ.) তাকে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের জন্য উৎসাহিত করেন। এ উৎসাহই তার জীবন বদলে দেয় এবং তিনি জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ করেন। ব্যবসার পাশাপাশি কুফার খ্যাতনামা শায়খদের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশেষত, ইমাম হাম্মাদ (রহ.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, যিনি ছিলেন ইবরাহিম নখঈ (রহ.)-এর প্রিয় ছাত্র।
কুফার জ্ঞানভাণ্ডারে সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি হারামাইন শরিফ ভ্রমণ করেন এবং ছয় বছর সেখানে অবস্থান করে হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি প্রায় চার হাজার মুহাদ্দিস থেকে হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করেন।
কর্মজীবন
১২০ হিজরিতে উস্তাদ ইমাম হাম্মাদের ইন্তেকালের পর তার মাদ্রাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাঠদানের পাশাপাশি তিনি কাপড়ের ব্যবসা চালিয়ে যান।
তাবেয়ি হওয়ার সৌভাগ্য
ইমাম আবু হানিফা বেশ কয়েকজন সাহাবির সোহবত লাভ করেন এবং তাবেয়ি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন:
- হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.)
- হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আউফা (রা.)
- হজরত সাহল ইবনে সাদ (রা.)
- হজরত আবু তুফাইল (রা.)
- হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)
জীবনচিত্র
ইমাম আবু হানিফা অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি অত্যধিক ইবাদত করতেন এবং প্রায় ৫৫ বার হজ পালন করেন। প্রতি রমজানে অসংখ্যবার কোরআন খতম করতেন। কথিত আছে, তিনি চল্লিশ বছর ধরে এশার অজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করতেন। ব্যবসায় সততা ও নৈতিকতার প্রতি এতটাই যত্নবান ছিলেন যে, সন্দেহজনক কোনো লেনদেনের অর্থ দান করে দিতেন।
অবদান
পাঠদানের দীর্ঘ জীবনে অসংখ্য ছাত্র তৈরি করেন, যারা পরবর্তীতে বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার প্রিয় ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ ছিলেন প্রধান বিচারপতি। তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- মুসনাদে আবু হানিফা
- আল ফিকহুল আকবার
- ওয়াসিয়াতু আবু হানিফা
- কিতাবুল আসার
গবেষকদের মতে, তিনি প্রায় ৪০,০০০ হাদিস থেকে বাছাই করে কিতাবুল আসার সংকলন করেন। তার সবচেয়ে বড় অবদান হলো, কোরআন ও হাদিস থেকে সাধারণ মানুষের জন্য মাসয়ালা নির্ধারণের মূলনীতি তৈরি করা, যা ফিকহে হানাফি নামে পরিচিত।
মৃত্যু
খলিফা আবু জাফর আল-মনসুর তাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি জালেম শাসকের সমর্থন এড়ানোর জন্য তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে খলিফা তাকে কারাগারে বন্দি করেন এবং প্রতিদিন দশটি করে চাবুক মারা হতো। চরম নির্যাতনের পর তাকে বিষ পান করিয়ে শহীদ করা হয়।
৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুন, ১৫০ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের মর্যাদা দান করুন এবং তার রেখে যাওয়া আদর্শের ওপর আমাদের পরিচালিত করার তাওফিক দিন।
আমিন।