সিটি টিভি নিউজ, 10/জুন/2017
হিজড়া বা ট্রানজেন্ডার হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরা সমাজে অনেক সময় অবহেলিত ও অবজ্ঞার শিকার হয়। যদিও তাদের সমাজে সঠিক জায়গা নিশ্চিত করতে নানা প্রচেষ্টা চলছে, তবুও এদের প্রতি বৈষম্য ও অজ্ঞতা এখনও অনেক জায়গায় বিদ্যমান। হিজড়া শব্দটি অনেকেই গালি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন, কিন্তু তাদের জন্য এটি একটি অভিশাপ নয় বরং সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রকৃতির নিয়মেই তারা পুরুষ বা নারী হিসেবে জন্ম না নিয়ে এক ভিন্ন রূপে জন্মগ্রহণ করে। তবে, হিজড়া হওয়া একটি সাধারণ শারীরিক বা মানসিক সমস্যা নয়, এটি একটি জটিল এবং গভীর বিষয়। আসুন দেখি কেন এবং কিভাবে কিছু মানুষ হিজড়া হয়ে জন্ম নেয়।
১. হিজড়া বা ট্রানজেন্ডার কী?
হিজড়া শব্দটি এসেছে আরবি "হিজরত" বা "হিজরী" থেকে, যার অর্থ 'পরিবর্তন' বা 'স্থানান্তর'। তারা শরীরতাত্ত্বিকভাবে বা মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুরুষ বা নারী হিসেবে অভ্যস্ত নয়, বরং এক ভিন্ন অবস্থানে থাকে। তারা নিজেদের লিঙ্গকে অন্যভাবে অনুভব করেন, যা তাদের শারীরিক গঠন বা মনের ভাবনার সাথে সম্পর্কিত।
২. হিজড়া হওয়ার কারণসমূহ
হিজড়া হওয়ার বিজ্ঞানগত ব্যাখ্যা মূলত ক্রোমোজোমের অনিয়মিত বিকাশের ওপর ভিত্তি করে। যেমন:
-
ক্রোমোজোমের ত্রুটি: সাধারণত নারী ও পুরুষের মধ্যে XX ও XY ক্রোমোজোম প্যাটার্ন থাকে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে ভ্রুণের ক্রোমোজোমে XXY বা XYY প্যাটার্ন দেখা যায়, যা শারীরিকভাবে হিজড়া শিশুর জন্ম দিতে পারে। এই ধরনের অস্বাভাবিক ক্রোমোজোমাল প্যাটার্নের কারণে তাদের শরীরে পুরুষ বা নারীর কোনও নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে প্রতিস্থাপিত হয় না।
-
হরমোনাল ব্যালান্সের সমস্যা: ভ্রুণের বিকাশকালে পুরুষ হরমোন (এন্ড্রোজেন) এবং নারীর হরমোন (এস্ট্রোজেন) এর মাঝে যে ভারসাম্য থাকা উচিত, তা যদি কিছু কারণে ব্যাহত হয়, তাহলে হিজড়া শিশুর জন্ম হতে পারে। যেমন, হরমোনাল প্রভাব বা এর অভাবের কারণে শরীরে হিজড়ার বিশেষ গঠন তৈরি হতে পারে।
৩. হিজড়া জন্মের বর্ণনা ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে
ইসলামে হিজড়া জন্মের বিষয়ে বিশেষ একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মতে, হিজড়ারা মূলত "জ্বীনদের সন্তান"। তিনি একদিন বলেছিলেন, "কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীর মাসিক স্রাব চলাকালে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে, শয়তান ওই সময় নারীটির গর্ভে প্রবেশ করে এবং সেই গর্ভে জন্ম নেয় হিজড়া সন্তান"। ইসলামের মতে, এ ধরনের সন্তানকে 'খুন্নাস' বলা হয়, যা মানুষ ও জ্বীনের যৌথ মিলনের ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়।
সূরা বানী ইস্রাইল ও সূরা আর রাহমানের কিছু আয়াত থেকেও এই ধারণা পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয় যে, কিছু সন্তান প্রকৃতির বিশেষ পরিবর্তনের ফলে এক ভিন্নভাবে জন্মগ্রহণ করে।
৪. হিজড়া সমাজ: বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, হিজড়া হওয়ার প্রধান কারণ হলো ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা এবং হরমোনের অভাব। অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মতো, হিজড়া হওয়ারও মূল কারণটি প্রাকৃতিক এবং কিছুটা অপরিহার্য হতে পারে। তবে সমাজের কাছে এটি একটি বিশেষ শ্রেণী হিসেবে পরিচিত এবং এদেরকে সম্মান দিয়ে সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা উচিত।
৫. হিজড়াদের বিভিন্ন শ্রেণীভুক্তকরণ
হিজড়াদের মাঝে তিনটি প্রধান শ্রেণী রয়েছে:
- অকুয়া: যারা শারীরিকভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিকভাবে নারীর মতো আচরণ করেন।
- জেনানা: যারা শারীরিকভাবে নারীর মতো কিন্তু পুরুষের আচরণ করেন।
- চিন্নি: যারা শারীরিকভাবে পুরুষ হলেও একেবারে পুরুষের বৈশিষ্ট্য বর্জিত থাকে এবং বিশেষ শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
৬. সমাজে হিজড়াদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি
হিজড়াদের প্রতি সমাজের মনোভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। তারা সাধারণত সহানুভূতির অভাবে তাদের জীবনে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়। তবে, বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থা তাদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করছে। হিজড়া সমাজের এই অবহেলিত অংশটি আসলে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতির দাবি রাখে।
উপসংহার
হিজড়া হওয়া কোনও বিকৃতির ফল নয় বরং এটি প্রকৃতির একটি বিরল বিকাশের ফলস্বরূপ। বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা বেশ কিছুটা পরিষ্কার হলেও, সমাজে তাদের প্রতি যে আচরণ তা পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। সঠিক তথ্য ও সচেতনতার মাধ্যমে আমরা তাদেরকে সমাজে সম্মানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন প্রদানে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারি।