এই ব্লগটি সন্ধান করুন

মাওলানা মাওদূদীর “ইসলামি সভ্যতা প্রকল্প”

মাওলানা মাওদূদীর “ইসলামি সভ্যতা প্রকল্প”

Post By: মোঃ তাজুল ইসলাম।
City Tv News, 01-Jan-2019.


মাওলানা মাওদূদীর সবচেয়ে বড় দোষ হলো তিনি ইসলামি সভ্যতা প্রকল্প নামে বিশাল কাজের আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। তার অবদান গুলোর কিছু এক অভিসন্দর্ভের আলোকে লিখলাম।


অনেক মনীষী ইসলামের ইতিহাসে এসেছে যাদেরকে খুব বিতর্কিত হতে হয়। তবে মৌলিক ভাবে ভালো আলিম ও যুগভেদী আলিমদেরকে শুধু বিতর্কিত হতে হয়নি মরতেও হয়েছে ভালো ভালো রাজা বাদশাহদের হাতে। আবু হানীফার বিষে নীল চেহারা, হাত ভাঙা ইমাম মালেকের ক্রন্দন, তিন খলীফার হাতে অত্যাচারিত আহমাদ বিন হাম্বলের অশ্রুর বন্যা, ইবনে তাইমিয়্যার বছরের পর বছর জেল খাটা, মুজাদ্দিদ আলফ আসসানীর গোয়ালিওর দূর্গে বেঁধে রাখার কষ্ট এই সব আমাদেরই ইতিহাস। 

তবে কষ্ট লেগেছে ইমাম আবু হানীফার (রা) বিরুদ্ধে যখন কিছু আলিম নামধারীরা ফতোয়া দিতো যে তিনি আলে বায়তের পক্ষের লোক। ইমাম মালেকের বিরুদ্ধে বলা হত তিনি বড়ই অহংকারী। ইমাম আহমাদকে বাতিল পন্থী বলে শত শত আলিমে ফতোয়া দিতো।

ইবনে তাইমিয়্যাহকে কুফরি ফতোয়ার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাই মাওলানা মাওদূদীর বিরুদ্ধে দেয়া ফতওয়াকে আমলে না নিয়েই আমি একটা অভিসন্দর্ভের সারমর্ম লিখলাম। সমালোচান করলেও আমার কেয়ার নেই, কারণ বুকে হিম্মত আছে বলেই সামনের সারিতে থাকি।

যাহোক, মাওলানা মাওদুদীকে পাশ্চত্য এখন কালো তালিকার প্রথম দিকে রেখেছে। অবশ্য সে তালিকায় মুহাম্মাদ বিন আবুদল ওয়াহহাবের নাম ও যেমন আছে দেওবন্দের নামও তেমন আছে বলে আমার আর এই নিয়ে মাথা ব্যাথা করেনা।


মাওলানা মাওদূদীর সবচেয়ে বড় দোষ হলো তিনি ইসলামি সভ্যতা প্রকল্প নামে বিশাল কাজের আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। তার অবদান গুলোর কিছু এক অভিসন্দর্ভের আলোকে লিখলাম।

১। তিনি ইসলামকে কালের ও যুগের চাহিদার আলোকে তুলে ধরার এক বিশাল ক্ষেত্র তুলে ধরেছেন। ইমাম নাদাওয়ী এইটাই সব সময় মাওদূদী সম্পর্কে বলে গেছেন। যে তিনি আধুনিক শিক্ষিতদের কাছে খুব ই বোধগম্য করে ইসলাম কে তুলে ধরেছেন। 

তার ইসলাম পরিচিতি বইটা পৃথিবীর সব ক’টি ভাষাতে অনুবাদিত হয়েছে। মাবিদিউল ইসলাম বই টা আমার এক আরব প্রফেসর কে পড়তে দিয়েছিলাম। তিনি বললেনঃ মাওদূদীর নাম অনেক শুনেছি, তবে এই বইটাই তার নাজাতের উসিলা হয়ে যেতে পারে।


২। তিনি দেখেছিলেন ভারত স্বাধীন হয়ে যাবে। এখানে মুসলমানদের শক্তি অর্জনের সুযোগ নিতে হবে। সেই সময়ের লেখা তার সব লেটারেচার দেখলে মনে হয় তিনি হিন্দু মুসলিম দুই জাতি চেতনায় ভারত স্বাধীন হোক এইটা চেয়েছিলেন। এতে মুসলমানদের খুব বেশি লাভ হয়নি এটা সত্য, কিন্তু ইসলামি রাস্ট্র ব্যাবস্থার যে প্রকৃত রূপ কি হবে তা চোখে আঙুল দিয়ে তিনি মানুষদের দেখিয়েছেন। 

এই রাস্ট্র ব্যাবস্থার স্বরূপ সন্ধানের তার যে সব দৃষ্টি ভংগী তাতে হাকিমিয়্যাতের কন্সেপ্ট ছাড়া আর কোন ব্যপারের কেও কথা বলেনি। তার দেখানো পথে ইখওয়ানের নেতৃত্ব প্রভাবিত হ্যেছে, হিযবুততাহরীর পথ দেখেছে, তাবলীগ নিজেদের কে সেই মহান পথের দিকে ধীরে ধীরে যাবার কথা বলেছে, হাসান তুরাবী ইনকিলাবের পথে যেয়ে পাওয়ার শেয়ার করেছেন, পাস ইসলামি হুকুমাত কায়েম করে কেলান্তনে সুপ্তি ভেঙেছে। ইসলামি রাস্ট্র ব্যবস্থার স্বরূপ প্রবর্তনের ফলে মুফতী শাফী (র) ও আইয়ুব খানের আমলে ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় মাওলানার কথা গুলো এতই দাম দিয়েছেন।

৩। ইসলামি আন্দোলন নামে তিনি ইসলামি জাগরণের একটা সিস্টেমেটিক পদ্ধতি উপহার দিয়েছেন। এখনো বাংলাদেশের যত গুলো ইসলামি দল ভালো ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা তার চিন্তাঞ্চেতনার বাইরে যেতে পারেনি। আপনি বিশ্বাস না হলে আহলে হাদীসের হারাকাতুশ হসুব্বানে সংবিধান ও কর্মপদ্ধতি দেখুন, খেলাফত আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি দেখুন। সাইয়েদের সমাজ বিপ্লবের ধারা পড়ুন।

হিযবুততাহরীরের ইসলামি খেলাফত প্রবর্তনের ধারা গুলো দেখুন। ঐ সব ঘুরে ফিরেঃ দাওয়াত, তানযীম, তারবিয়্যাত, মুয়াশারাত ও হুকুমাত। ঐ ঘুরে ফিরে ক্যাডার। ওই ঘুরে ফিরে আমীর, নায়েবে আমীর, শুরা, ইউনিট ইত্যাদি ইত্যাদি। 


৪। তিনি ইসলামকে সার্বজনীন মতাদর্শ ও কমপ্লিট কোড ও লাইফ বলতেন। তিনি সব দিকে দিয়েই একজন মুসলিমকে ইসলামী হয়ে উঠতে বলতেন। সব মানবেন, আবার ঘুষ খাবেন, বড় দাড়ি ও জুব্বা পরে সুদের কারবারীতে লগ্নি খাটাবেন, এই রকম দ্বৈততা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে বলেন মুসলিম সমাজকে। যদিও তার এই কথা আজো মনে হয় বাস্তবিক নয়। কিন্তু মুসলিম হবার অর্থ তো উদখুলু ফিস সিলমি কাফফাহ।

এই পূর্ণ মুসলিম হবার চেতনাটাকে তিনি ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাস্ট্রীয় আঙীনায় ও বৈশ্বিক প্রবাহে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন। তার তাযকিরাতুদ দুআহ বইটা পড়ে আরবদের রাতের ঘুম ও হারাম হয়ে যেতো ক্রন্দনের কাতরতায়।

৫। তিনিই ছিলেন বিশ শতকের প্রথম ব্যক্তি যিনি সুদের প্রকোপ থেকে বের হবার পথ সুদ ও ইসলামিক ব্যাংকিং কিংবা ইসলামের অর্থনীতির সহায়ক গ্রন্থ লিখে মানুষকে পথ দেখান। তার চিন্তা ধারা গুলো প্রফেসর খুরশিদের মত অর্থনীতিবীদ, উমার চাপড়ার মত ব্যাংকিং ইঞ্জিনিয়ার রা লুফে নেন। হয়ে ওঠে সারা দুনিয়ায় নাম করা এক দর্শন “ইসলামি অর্থনীতি”। 

আজ তাই বিশ্বের সমগ্র নামকরা প্রতিষ্ঠানে মাওলানা মাওদূদীর এই চিন্তা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়, ক্লাসে ক্লাসে, গবেষণার মাজলিসে, গ্রন্থে প্রবন্ধে কিংবা ছাত্র ছাত্রীদের কাকলিতে।

৬। ইসলামি সাংস্কৃতিক জীবন হলো ইসলামের এক বিশালায়তন। তিনি বুঝেছিলেন এই যায়গায় আমাদের দূর্বলতা আজ আমাদের শেষ যায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। নিজেই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক, সেরা সাহিত্য সেবী, মনোমুগ্ধকর ভাষা শৈলীর জন্মদাতা। সে সাথে গড়ে তুলে ছিলেন দারুত তারজামাহ।

দারুত তাসনীফ। পাশে তৈরী করেছিলেন লেখক বাহিনী, যারা আজো ভূভারতের সেরা লেখিয়ে। আপনি মানহাজ আল ইঙ্কিলাব আলইসলামি বা ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা পড়েন, আর ইমাম নাদাওয়ীর মাযা খাসিরার মাঝে “মহানবীর বানানো সমাজ নির্মানের কলা কৌশল” টা পড়েন। দেখবেন কি সুন্দর চিন্তার ঐক্য। 

তাদাব্বুরে কুরআনের লেখকের মাওলানা ইসলাহীর তানক্বীদাত পড়েন দেখবেন কত মিল তাদের। ইসরার আহমাদের বক্তৃতার ভান্ডার দেখেন, তিনি কি মাওদূদীর চিন্তা থেকে এক ইঞ্চি বের হয়েছেন। তিনি ঐ সব লেখিয়ে দের দিয়ে ইসলামি সাহিত্যের যে ভান্ডার আজ সৃষ্টি করেছেন তা ইতিহাসে কম দেখা যায়। গল্প কবিতার অংগনে মানুষের পথ দেখিয়েছেন। 

নাসীম হিজাযীর বই গুলো আজ মাওদূদীর অনুপ্রেরণায় ঋদ্ধ। তিনি রেডিও টিভি, সিনেমা নাটক ইত্যাদির ব্যাপারে এমন সময় পজিটিভ কথা বলে গেছেন যখন এই কারণেই অনেক উলামা তাকে বিভ্রান্ত আখ্যা দেয়। অথচ সেই সব আলিমগণের ছাত্ররা আজ এর সবের পেছনে সময় দেয়া দ্বীনের ফরয মনে করছেন।

৭। ইসলামি দর্শনের ব্যাপ্তি সৃষ্টিতে মাওদূদীর অবদান আজ সূর্যের আলোর মত দেদিপ্যমান। তিনি আক্বাইদের বিভিন্ন দার্শনিকতার বিরোধিতা করেছেন। এক্ষেত্রে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার কথা তিনি খুব পছন্দ করেছেন। ইমাম গাযযালীর নানা দর্শনের সমালোচনা করেছেন। 

তার আলোচনা গুলো হাদীস ভিত্তিক না হয়ে ইলমুল কালামের গন্ডিতে নিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি ফিক্বহের বিভিন্ন বিষয়কে সেকেলে ভাব ধারা থেকে আধুনিকায়নের কথা বলেছেন। তিনি চার মাযহাবের ভেতরেই আবদ্ধ না থেকে ইসলামের মৌলিক মাসাদির গুলো থেকে দৃষ্টি ভংগি নিয়ে আধুনিক গবেষণার ইকবালীয় বা হাসানুল বান্না দর্শনকে সঠিক মনে করেছেন। 

আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসার জবাবে তার উত্তর গুলো হতো খুব ই ইজতিহাদ ভিত্তিক। যদিও মৌলিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক হোঁচটা তাএ খেতে হত বলে একেকটা বিষয়ে তাকে অনেক চেইঞ্জ আনতে হতো। হাদীস এর মতন ও সনদ দিরায়াতের ক্ষেত্রে আমি বলবো আপনি নাসিরুদ্দীন আলবানীর হিজাবুল মারআহ আলমুসলিমাহ বই টা পড়ুন। 

বিশেষ করে মাওদূদীর সাথে তার আদান প্রদান করা চিঠি গুলো দেখলে বুঝবেন আলবানী সাহেব কে তিনি কি উপহার দিয়েছেন। এটাও ঠিক আলবানী সাহেব ও তার অনেক বিষয়ে চোখ খুলে দিয়েছেন। তিনি কুরআন স্টাডীর ক্ষেত্রে বেশ কিছু দিক নিয়ে এসেছেন যা বুঝার মত। তাফহীমের ভূমিকা, তার আলোকে লেখা খুররাম মুরাদের কুরআন বুঝার সহায়িকা খুব ই দিগন্তভেদী।


৮। ইসলামের বিভিন্ন মতবাদের ঠিকাদারদের ব্যাপারে তার অর্গল ভাঙা ব্যাখ্যা মানুষকে পথ দেখায়। আজো তার কাদিয়ানীয়্যাতের সমালোচনা, আল হিজাব এ উলংগপনার বিরুদ্ধে হুংকার, দ্বিজাতি তত্বের ব্যাখ্যা তার আপোষকামিতার মনে পদাঘাত, হাদীস বিরোধিদের সামনে সমালোচনার পাহাড় ছিলো আসলে উপভোগ্য। 

সূফীদের কারসাযির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সিপাহসালার, নব্য জাহেরিদের বিপক্ষে ছিলো তার নগ্ন অবস্থান, এবং আধুনিক মু’তাযিলাদের নিয়ে তিনি ইদুর বিড়াল খেলতেন। আমাদের দেশের বরেণ্য মাওলানা আযীযুর রহমান নেসারাবাদী সাহেব তাকে বলতেনঃ মাওদূদী ছিলো ইবনে তাইমিয়্যার নতূন ভার্সন।


রাজনৈতিক প্রজ্ঞাতে আমি মাওদূদীকে খুব বলিষ্ঠ মনে করিনা। আমি কখনো তাকে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের সারিতে তাকে দেখিনা। কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন সব্যসাচী লেখক। ইসলামের ইতিহাসে যিনিই এই রকম ধারায় চলেছেন তার ভুল ও কম হয়নি। 

ইমাম সুয়ূতি সম্পর্কে ইমাম সাখাওয়ীর আলোচনা শুনলে সত্তরবার ইস্তেগফার পড়া লাগে। কিন্তু আমাদের যুগে কি যে হয়েছে, স্কলারদের ভুল হলেই তাকে দেয়া হয় কুফরী, নিফাক্বী ও নাসার ইয়াহুদীদের দালাল অভিধা। 

যারা ইমাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাবের তুর্কী খেলাফতের বিরোধিতা দেখেছে, যারা মুফতী আহমাদ শফী সাহেবের আওয়ামী গুণকীর্তন দেখে ও আবেগে গদ গদ হয় তারাই দেয় মাওলানা মাওদূদীকে কাফির ফতওয়া, এর চেয়ে জোক আর কি হতে পারে।

Abul ala maududi All books
Visit Now

Maulana maududi quotes

ধন্যবাদান্তে
মোঃ তাজুল ইসলাম
লেখক, আই টি এক্সপার্ট।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.